নিয়ম ভাঙার পক্ষে নই, নতুন নিয়মের পক্ষে

৩০শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ । ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জীবন ডায়েরী : রাশেদ রেহমান

পৌষ মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। চারিদিকে কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। সবেমাত্র প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির রোল নম্বরটা বেজোড় সংখ্যা হওয়ায় ক-শাখাতে মনোনীত হই। মাত্র দু-একজন বাদে ক-শাখার প্রায় সকল বন্ধুই ছিল নতুন এবং বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা। শ্রেণিতে প্রথম দিনই নামের পাশে দুষ্টু শব্দটা পাকা পোক্ত করে নিয়েছিলাম। কারণ বিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুদর্শন এবং নায়ক খ্যাত শিক্ষক জিন্নাহ স্যারের পাঠদানের সময় তার বক্তব্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে শ্রেণি কক্ষের সেলিং বিহীন ধন্নার উপর একজোড়া চড়াই পাখির সঙ্গমরত অবস্থা দেখে হিঃ হিঃ হিঃ করে হেসে উঠি। স্যার তৎক্ষণাত হাতের ডাস্টারটা বোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ছুড়ে মারেন। আমি সুযোগ বুঝে মাথা নিঁচু করি। হতভাগ্য ডাস্টারটা পিছনে বসা ইভার মাথায় আঘাত করে এবং মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। স্যার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষ পর্যন্ত বিচারটা প্রধান শিক্ষক বরাবর গড়ায়। হেড স্যার জিন্নাহ স্যারকে কিছুটা ভর্ৎসনা করে আমাকে জোড় বেত দ্বারা দশটি আঘাত করেন। তারপর থেকে দুষ্টু শব্দটা নামের সাথে আঠার মত লেগে আছে। তাই বলে লেখাপড়ায় পিছিয়ে ছিলাম না। প্রত্যেক শ্রেণিতেই প্রথম হতাম এবং শ্রেণির সবাই আমাকে ভালবাসত ও খুব বিশ্বাস করত। ক্লাসের ক্যাপটেনসহ রাতে আমরা কিছু ফলমূল নিয়ে ইভাকে দেখতে গেলাম।

ইভার মা ইসমত আরা বেগম বাদামী টুল পেতে আমাদের বসতে দিলেন। সবাইকে দেখে ইভা জুঁইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল- তোমরা আমাকে এত ভালবাস? তারপর থেকে ইভার সাথে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব শুরু। প্রমত্তা যমুনার প্রত্যন্ত চরে আমাদের বসতি। প্রতি বাড়িতে টিউবওয়েল থাকার পরও আমরা দল বেঁধে বালুচর হেঁটে যমুনার মিষ্টি স্রোতে গা ভাসিয়ে গোসল করতাম। কিনারে বসে ভেজা বালিতে অট্টালিকা, পাহাড়, পর্বত বানানো; নল নল আর ঝাপুড় ঝুপুড় সহ কত রকম জলকেলিতে মেতে থাকতাম। নদীতে পাল তুলে নৌকা যেতো। বাতাস না থাকলে সড়াৎ সড়াৎ শব্দে দাড় বেয়ে কখনোবা গুন টেনে চলে যেতো দূর দিগন্তে। মাছরাঙ্গা, শালিক মাছের নিশানায় যমুনার স্বচ্ছ জলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। মাছের সন্ধান পেলেই ঝপাৎ করে ধরে নিয়ে উড়ে যেত কাশবনের দিকে। ইভা কিনারে বসে যমুনার পাললিক সৌন্দর্য দর্শনে হারিয়ে যেতো প্রকৃতির মায়াজালে।
ইভা, জুঁই, নেহা, ইফতি, পরশ ওরা শুধু আমার পড়ার সাথীই নয়; খুব ভাল বন্ধুও। দুষ্টুমি হেতু গাছের আম চুরি থেকে শুরু করে কানামাছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, চিক চিক চাঁদের আলোয় খই খই খেলা, পুঁথি পাঠ শোনা সবই এক সাথে করতাম। ঘুমানো বাদে সারাক্ষণ এক সাথে চলতাম। ইভাদের বকুল গাছ ছিল। প্রতিদিন সকালে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্য বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসত। ওর মালা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সবাই ঈর্ষা করত। মালার লোভে আমি খুব ভোরে গিয়ে বই-পুস্তক রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।

যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি ঠিক সেই সময় একদিন ইভার জন্য রাস্তায় পরশ ও আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ গাছের দিকে তাকাতে পরশের চোখ দুটো ছানাবড়া। বলল- দেখ দেখ গাছে কি লেখা? দেখলাম প্রত্যেক গাছের ছাল কেটে লেখা “রাসেল + ইভা”। ঐ ঘটনার জন্য আমাকে অফিস রুমে ডাকা হলো এবং আমার হাতে এসিড গাছের পাতা দিয়ে ঝলসানো “ইভা + রাসেল” লেখা থাকার কারণে ঐ ঘটনার দায়ভার আমার উপর বর্তালো। আবারও জোড়া বেতের দশ ঘা। বেতের পটাপট দশ জোড়া চুম্বন অতি কষ্টে গলাধকরণঃ করে সেদিনকার মত পাঠ চুকিয়ে বড় বোনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। কারণ আমার মা আয়েশা বেগম অত্যন্ত ভয়ংকর একজন নারী। সামনে পেলে আরও দু-চার ঘা মারতে পারে এই ভয়ে।

দুপুরে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বুবুদের বারান্দায় বসে ভাবছিলাম কে করতে পারে এসব কাজ। তখন কিন্তু দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল। দিনের তেজস্বী সূর্যটা তাপদাহ কমিয়ে পৃথিবীময় প্রশান্তির পরশ বুলাতে ব্যস্ত। সকালে খাবারের সন্ধানে বের হওয়া পরিশ্রান্ত পাখির দল নীড়ে ফিরছে। কর্মক্লান্ত রাখাল গরুর পাল নিয়ে ছুটছে বাড়ি ফেরার প্রত্যয়ে। ভাবনার ঘোর না কাটতেই এক জোড়া হাত আমার চোখ ধরে ফেলে। চিরচেনা উষ্ণ পরশ অনুভব করে বললাম- ইভা। হাত দুটো সরাতেই মায়ের মায়াভরা মুখখানি গোচরীভূত হয় এবং লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরাই। ওরা যে মাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে বিষয়টি আমি আঁচ করতে পারি নি।

মা সহসা হাত ধরে বলে চল বাড়ি চল। আর ইভা শোন তোমরা সবাই রাতে আমাদের বাড়িতে আসবে। কেরাম চাচা পুঁথি পাঠ করে শোনাবে।
আমিও মায়ের কথায় সায় দিয়ে বলি তোরা অবশ্যই আসবি। আজকে শহীদ কারবালার পুঁথি পাঠ শুনব।
গ্রামে পুঁথি পাঠ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান-বাজনা হয়। থিয়েটার, নাটক, বাউল গান, নছিমনের জারি, বেহুলার কিচ্ছা, যাত্রা ইত্যাদি। যাত্রায় ছেলেরাই মেয়ে সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করত।

বয়স ও সময় থেমে থাকে না। এভাবে চলতে চলতে কখন যে স্বপ্নমাখা শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে কৈশোর নামক নতুন জীবনে পদার্পণ করেছি তা বুঝতে পারি নি। আমরা এসএসসি পাশ করে যে যার সুবিধামত বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়েছি। এখন লেখা-পড়ার প্রচণ্ড চাপ। উন্নত জীবন গড়ার প্রত্যয়ে সবাই বলীয়ান। তবে ইভার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা প্রেমে রূপ নেয় আরও অনেক আগে। বকুলের মালার সাইজটাও এখন অনেক বড় হয়েছে। ইভার সাথে আমার সম্পর্ক এতই গভীর যে, হৃদয়ের গহীনে তার অবস্থান। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইভার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অলীক পরিবর্তন আমাদের গলায় গলা জড়িয়ে ছুটোছুটি করা থেকে বিরত রেখেছে। নামের পাশ থেকে কখন যে দুষ্টু শব্দটা ঝরে গেছে ঠাহর করতে পারি নি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে অনার্সে ভর্তি হই। ইভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় এবং মামার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করে। অবস্থানগত জটিলতার কারণে প্রতিদিন আমার আর ইভার দেখা করা সম্ভব হয় না।

দীর্ঘ আট মাস পর রোযা এবং ঈদের ছুটিতে গ্রামে ফেরা। বাড়িতে ব্যাগ পত্র রেখেই দৌড় দেই ইভাদের বাড়িতে। ইভার মায়ের মলিন অবয়ব দেখে মনটা হোঁচট খায়। আমি ছালাম দিতেই খালাম্মা বলেন- রাসেল, কখন আসলে বাবা?
এইতো কিছুক্ষণ আগে।
ওমা তাই, ইফতিও এসেছিল কিছুক্ষণ আগে। ইভাকে ওর মামা আসতে দেয় নি। ঈদে ওরা কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে তাই। তাছাড়া শুনেছি ঈদের পরের দিন নাকি কক্সবাজারে শুটিং আছে। তা বাবা তুমি কেমন আছো?
আমি শুধু মুখে ভাল আছি বলেই হাঁটতে শুরু করি ইফতিদের বাড়ির দিকে। পথেই ইফতির সাথে দেখা হয়। নাটুয়ার পাড়া কলেজ মাঠে দূর্বা ঘাসের উপরে বসে ইফতি বয়ান করতে থাকে ইভার শুটিং করার দুর্লভ কাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কিছুদিন নিয়মিত ইভার সাথে দেখা হত আমার। তারপর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ওর নাচ দেখে আমি রীতিমত বিমোহিত। ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ললিতকলা বিভাগে নাচ ও অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ইভার মামাত ভাই রেজা মিউজিক ভিডিওর নাম করা পরিচালক। তাছাড়া মহানগর নাট্যশালার সে সাধারণ সম্পাদকও। রেজা ভাইয়ের মিউজিক ভিডিওতেই ইভা প্রথম অভিনয় করে এবং এ্যালবামটি ব্যাপক দর্শক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রেজা ভাইয়ের প্রথম ছবি ‘নীলমেঘ’-এ পার্শ্ব নায়িকা হিসেবে রিয়াজের বিপরীতে অভিনয় করছে ইভা। ঐ ছবির গানের দৃশ্য শুটিং করার জন্যই কক্সবাজারে গিয়েছে।

ইফতির কথাগুলো শুনে আমার স্বপ্নময় ভবিষ্যতের নীলাভ আকাশটায় বেদনার কালো ছাই মেঘ ভিড় করে। অনেক দিনের গড়া ভালবাসা মাঝি বিহীন নৌকায় তীরে ভেড়ার প্রত্যয়ে হিমশিম খায়। যে ইভা কোন কারণে দিনে দেখা না হলে রাতে ওর বড় ভাইয়ের প্যান্ট-শার্ট-ক্যাপ পরে চুপিসারে ঢুকে যেতো আমার ঘরে, কত যে রাত গলা জড়াজড়ি করে ভরা জোছনায় ভিজেছি। পড়ন্ত বিকেলে মুখে সরষে ফুলের পরাগ মেখে ফসলি জমির আইল ধরে ছুটেছি। গোধূলিমায় বায়না ধরত চাঁদের বুড়ির সুতা কুড়িয়ে মাথায় দিতে, মাথার চুল কালো করার জন্য। তার বায়না পূরণ করার জন্য হন্যে হয়ে ছুটেছি মাঠের পর মাঠ। সেই শান্ত-সহজ-সরল বালিকা ইভা এখন বাংলা সিনেমার নায়িকা।

ইফতিকে বিদায় দিয়ে রাতে বাড়ি ফিরি। নিদ্রাহীন কেটে যায় কয়েকটি রাত। বুকভরা হতাশা আর ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে কোনমতে ঈদের ছুটি শেষে রাজশাহীতে চলে যাই। তারপর থেকে বন্ধুদের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। মাঝে কেটে যায় চারটি বছর। এমকম কমপ্লিট করে ঢাকাতে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিতে যাই। সেখানে দেখা হয় ইফতির সাথে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ইফতি থাকার কারণে চাকরিটা সহজেই হয়ে যায়। রাতে ইফতির ওখানেই উঠি। ঘুমানোর আগে ইফতি জিজ্ঞেস করে- কিরে, ইভার খবর জানিস?
কেন কি হয়েছে ওর? গত চার বছর যাবত আমার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আমি বিভিন্নভাবে খবর নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ————-।
কথা শেষ না হতেই ইফতি বলে- ইভা এইচআইভি পজেটিভ। এক বছর আগে ধরা পড়েছে। মডেলিং করতে গিয়ে অনেক লোকের সাথে সম্পর্ক হয় ইভার; যে সম্পর্ক দৈহিক পর্যন্ত গড়ায়। যার কারণে মরতে বসেছে আজ। এখন নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে। ইভার নম্বর আছে, কথা বলবি?
বললাম হু। কল দিতেই প্লে ব্যাক টিউন বেজে ওঠে- “হৃদয় উজাড় করে একটা জীবন করে যাব তোমার প্রার্থনা ————-।”

ফোন ধরে ওপাশ থেকে বলে ওঠে হ্যালো ইফতি?
বললাম- না, আমি রাসেল।
রাসেল, কেমন আছ? শুক্রবার একবার দেখা করতে পারবে? আমি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসার সামনে থাকব।
উত্তরে শুধু বললাম- পারব।
শুক্রবার আর দেখা হয় নি ইভার সাথে। ওর ছোট ভাই এসে বকুল ফুলের একটি মালা দিয়ে বলেছিল- আপু এটা আপনাকে দিতে বলেছে। আপুকে কাল রাতেই সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ।
এখন মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়াই যদি কাউকে বলতে শুনি- ‘স্যার মালা নিবেন? বকুল ফুলের মালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নিয়ম ভাঙার পক্ষে নই, নতুন নিয়মের পক্ষে

উপদেষ্টা:

১. জাহাঙ্গীর ফিরোজ
২. কামরুল আজাদ
৩. এস এম সাথী বেগম
৪. ডা. আব্দুস সামাদ

প্রধান সম্পাদক:

বান্দা হাফিজ

সম্পাদক:

রোশনী ইয়াসমিন

সহকারী সম্পাদক

ফারুক ফরায়েজি

প্রকাশক:

মোঃ ওমর ফারুক

ঠিকানা:

৫৬, চানখারপুল, নাজিমুদ্দিন রোড, বংশাল, ঢাকা-১১০০

যোগাযোগ:

মোবাইল:
০১৫৮১-৬৬০৯১৯
০১৬১৯-৪৫১৬০৪

ইমেইল: sahityodarbar@gmail.com

Copyright © Sahityo Darbar
Built with care by Pixel Suggest